সুন্দরবনঘেঁষা ইউনিয়ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী। দুই ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে সুখের সংসার ছিল দাতিনাখালী গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমের। কিন্তু গত বুধবার রাতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উড়ে গেছে তাদের মাথাগোঁজার ঘর। জোয়ারে তলিয়ে গেছে বেঁচে থাকার বড় অবলম্বন কাঁকড়ার ঘের। এক রাতের ঝড়েই ডুবে গেছে সব স্বপ্ন।
গতকাল শুক্রবার শেষ বিকেলে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আলাপকালে গলা শুকিয়ে আসছিল জাহাঙ্গীরের। কাতরকণ্ঠে বলেন, 'মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কাঁকড়া চাষ করি। কিছুদিন আগেই এনজিও থেকে তিন লাখ এবং ব্যাংক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। ঘরে সঞ্চিত দুই লাখসহ সাত লাখ টাকা দিয়ে এই মৌসুমের চাষ শুরু করি। জোয়ারে সবই তলিয়ে গেছে। থাকার ঘরটির নিশানাই খুঁজে পাইনি। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। কেউ থাকার জায়গা দিলে থাকব, খাবার দিলে খাব। সব শেষ হয়ে গেছে, আমাদের কোনো ঈদ নেই।'
সুপার সাইক্লোন আম্পানে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত উপকূল। বুড়িগোয়ালিনীর ক্ষতি অনেক বেশি। বিদ্যুৎ সংযোগ তখনও বিচ্ছিন্ন। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে কথা হয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মণ্ডলের মোবাইল ফোনে। চেয়ারম্যান সমকালকে জানান, শুধু জাহাঙ্গীর নয়, তার ইউনিয়নে প্রায় সবার বেঁচে থাকার মতো কিছু বাকি নেই। কমপক্ষে তিন হাজার মানুষের চিংড়িসহ বিভিন্ন মাছের ঘের এবং কাঁকড়ার খামার জোয়ারে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এই ঘের ও খামারের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার বিঘা।
ভবতোষ বলেন, 'করোনার কারণে এমনিতেই মানুষ কর্মহীন, উপার্জনহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আম্পান এসে একেবারেই শেষ করে দিয়ে গেছে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঈদ উৎসবের আমেজ থাকার কথা। কিন্তু গ্রামের পর গ্রাম এখন পানির নিচে। যেদিকেই যাই, শুধু কান্না আর কান্না। চারদিকে শুধুই বিষাদ। এবার যেন বিষাদেরই ঈদ।'
শ্যামনগরের আরেকটি ইউনিয়ন গাবুরা। নেবুবুনিয়া গ্রামের তরুণ রাশেদুল হাসান ঢাকার কেরানীগঞ্জে একটি পোশাক কারখানার হিসাব বিভাগে চাকরি করতেন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে রাশেদুল কর্মহীন হয়ে পড়েন। অগত্যা গ্রামে গিয়ে বাবা ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে মাছের ঘের দেখাশোনা করতে থাকেন। কিন্তু অনেক ঘেরের মতো তাদের এই ঘেরও তলিয়ে গেছে জোয়ারের পানিতে।
রাশেদুল সমকালকে বলেন, 'মাছের ঘের তো গেছেই, থাকার ঘরটাও রক্ষা পায়নি। এখন আমাদের ছয় সদস্যের পরিবারে অন্ধকার ছাড়া কিছু নেই। আমরা কী করে ঘুরে দাঁড়াব আর কী নিয়ে বেঁচে থাকব! সরকার সহযোগিতা করলে হয়তো এই অবস্থা থেকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারব।'
গাবুরা ইউনিয়নের খোলপেটুয়া গ্রামের বাসিন্দা মনছুর মিয়া সুন্দরবনে ঘুরে ঘুরে কাঁকড়া ও মাছ আহরণ করে সংসার চালান। ছোট্ট একটি মাছের ঘেরও ছিল তার। জোয়ারের পানিতে সেটি তলিয়ে গেছে। ঝড়ে উড়ে গেছে থাকার ঘর। সাত সদস্যের সংসার মনছুরের। ছোট সন্তানদের নিয়ে তিনি পথে বসে গেছেন।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে জানিয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল বাছেদ সমকালকে বলেন, এখনও ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ, মাছের ঘেরসহ সম্পদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই সাতক্ষীরায়। মানুষের মধ্যে ভয়, হতাশা আর হারানোর যন্ত্রণা। করোনার মধ্যেই ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব তাদের আরও নিঃস্ব করে দিল। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে তাদের আবারও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
0 Comments
Please Do Not Enter Any Spam Link In Comment Box.
Emoji